বাবাকে কখনো বাবার মতো মনে হয় নি। গায়ের অন্য ছেলেদের বাবারা তাদের ছেলেদের সাথে যেমন বাবাসূলভ আচরণ করত আমার বাবা আমার সাথে তেমন করত না। আমার মুখের দিকে কখনো দেখতই না। মাসে এক কি দু’বারই তাকাত। যখন তাকাত ঘোমড়োমুখো চাহনিতে তাকাত। মাসে দু-একবার বকা দিত। কাজের লোকেরা ভালোভাবে কাজ করলে বাবাতো কখনো তাদরে প্রসংশাই করত না বরং মাঝে মধ্যে একটু হেরফের করলে বকাঝকায় ফকফকা হয়ে উঠত তার মুখচ্ছবি। ক্লাসে প্রথম হয়েছি বলে, অথবা আমার কোনো কৃতকার্যে কখনো উজ্জ্বল হতে দেখিনি তার মুখ বরং মাঝে মধ্যে আমার অঘটণপ্রেয়সী মনটা জেগে উঠলে ঝাড়ি দিয়ে মলিন করতো আমার মন। বাবার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। আমাকে দিয়ে সিগারেট আনানোর সময় যখন হাতে টাকা গোঁজে দিত তখনো আমার দিকে তাকাতো না। যখন সিগারেট এনে বাবার হাতে দিতাম তখনো বাবা আমার মুখের দিকে তাকাতো না। বাড়ির সবার মতো আমিও বাবাকে অসম্ভব ভয় পেতাম। সহজে বাবার সামনে পড়তাম না। বাবার আড়ালে আবড়ালে চলাফেরা করতাম। যে পথে বাবার গতায়াত ছিল সে পথে কোনোদিন আমার পায়ের ছাপ পড়েছে কিনা তা অনেক মনে করে বলতে হবে। সর্বদা বাড়িতে খাবারের উৎসব লেগে থাকতো। “চাহিবা মাত্র ইহার খাদককে দিতে বাধ্য থাকিব” এটা উহ্য লেখা থাকত খাবারের গায়ে। বাবা কি নিজের চাহিদা মেটানো অথবা আমাদের ভালোবেসে এতটা খাবার এনে বাড়িতে রাখতো তা আমার কোনোদিন আবিষ্কার করা হয়ে উঠে নি। আমার ক্লাসে দ্বিতীয় হয়েছিল বলে রাহুলকে তার বাবা বাই-সাইকেল কিনে দিয়েছিল। টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর বাড়িতে জানালাম। সবার খুশির ছোঁয়াটুকুনও স্পর্শ করে নি বাবাকে। সেবার রাহুলের সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাওয়ায় আর বাবাকে দেখেছিলাম যেন সে সোনার মানিক পাওয়ায় আনন্দিত। বৃত্তি পেয়েছিল বলে রাহুল তার বাবার কাছ থেকে কম্পিউটার পেয়েছিল।
বাবার খাওয়ার পর আমরা খেতে বসতাম। আমাদের খাওয়ার পরম মা খেত। বাবা খুব পরিশ্রম করত বটে। রোজগারের ব্যাপারে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না। এস.এস.সিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার খবর বাবার কানকে খুব প্রশস্ত করে নি। বাসায় নিয়মিতই পড়াশোনা করতাম। বাব একদিন বাসায় ছিল না বলে খেলতে গিয়ে দেরী করে বাসায় ফিরলাম। স্যার এসে বাড়িতে পড়িয়ে গেল । আমায় পেল না। এ খবর বাবার কানে পৌছাতেই একনাগাড়ে আমার উপর অনেকক্ষণ কথার বজ্রপাত হলো। মেঘহীন মনের আকাশ ভারী বর্ষনে তলিয়ে নিল সব আহলাদ। বাবা আমাদের মারে নি কখনো। তবে সেদিন না মারলেও ভয়ে হোক অথবা কষ্টে আমি ডুকরের ডুকরে অনেক কেদেঁছিলাম। কলেজ পাস করে আমাকে অনেক কষ্টের ঢোক গিলতে হয়েছিল। অল্পের জন্যে এ প্লাস মিস করেছিলাম বলে সেবার অনেকদিন পর বাবার মন খারাপ হতে দেখেছিলাম। কারণ এ খবরও বাবা শুনেছিল অনেকদিন পর। রফিক নামে বাবার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে বাবাকে অনেক প্রসংসা করল। বলল “গ্রামের ছেলের দৌড়তো অনেক। তোর ছেলে আসলেই জিনিয়াস। তুই ও কম না। নয়লে তোর ছেলে এমন মেধাবী হয় কেমনে?” বাবার মনে তখন একটু খুশির আচঁ লেগেছিল বটে। বন্ধুর অহেতুক কথায় বাবা জিঙ্গেস করল “কেন, সে এমন কি করল?” বন্ধু বলল “গ্রামর কয়জন ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, বল? এটা কম কথা না?” এ কথা শুনে বাবার মনটা সত্যিই খুশিতে প্রফুল্ল হয়েছিল। এরপর বাবা আদরমাখা পলক পেলে সত্যি সত্যি তাকিয়েছিল আমার মুখপানে। চোখে মুখে তার সন্তুষ্টির আভা প্রস্ফুটিত হচ্ছিল। আর প্রথমবারের মতো আমার মনে হচ্ছিল “ইনি আমার বাবা”।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
০৫ মে - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।